বাচ্চাদের দাঁত ওঠার লক্ষণ ও দাঁত ওঠার সময় কি করণীয়
বাচ্চাদের দাঁত উঠার সময় পিতা-মাতার কিছু দিকে লক্ষ্য রাখতে হয় এবং সেই অনুযায়ী পিতা-মাতার কিছু করণীয় পদক্ষেপ নিতে হয়। বাচ্চাদের দাঁত ওঠার সময় এই লক্ষণ গুলো ও করণীয় দিকগুলো নিয়েই মূলত আজকের এই ব্লগ তৈরি করা হয়েছে।
বাচ্চাদের দাঁত ওঠার সময়টি একটি আনন্দদায়ক মুহূর্ত । কিন্তু এই সময় অনেক জটিলতার পদক্ষেপ নিতে হয়। এই সময় বাচ্চাদের মাঝে কিছু লক্ষণ দেখা যায়, যা পিতা-মাতার জন্য চিন্তার কারণ হতে পারে। দাঁত ওঠার প্রক্রিয়াটি সাধারণত ৬ মাস বয়সের দিকে শুরু হয় এবং দুই থেকে আড়াই বছর বয়সের মধ্যে সম্পন্ন হয়। বাচ্চাদের দাঁত ওঠার সময় পিতা-মাতার কিছু করণীয় দিকনির্দেশনা পালন করতে হয়।
দাঁত ওঠা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ যা প্রকৃতি বাচ্চার জীবনে আসে। দাঁত ওঠার সময় বাচ্চাদের অস্বস্তি, ব্যথা ও বিভিন্ন শারীরিক পরিবর্তন দেখা যায়। পিতা মাতার জন্য এই সময়টি কিছুটা চ্যালেঞ্জিং হলেও, সঠিকভাবে যত্ন ও সহায়তার মাধ্যমে বাচ্চাদের এই সময়টি সহজ করে তোলে।
আমাদের আজকের এই ব্লগে আমরা বাচ্চাদের দাঁত ওঠার লক্ষণ ও দাঁত ওঠার সময় করণীয় কি কি এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
বাচ্চাদের দাঁত ওঠার লক্ষণ
বাচ্চাদের দাঁত ওঠার সময় অনেকগুলো লক্ষণ নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই লক্ষণ গুলো সম্পর্কে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। নিচে আলোচনা করা হলো -
- লালা ঝরানোঃ দাঁত ওঠার সময় বাচ্চাদের মুখ থেকে প্রচুর লালা ঝরে। এটি সাধারণত ৩ থেকে ৪ মাস বয়স থেকে শুরু হয় এবং দাঁত পুরোপুরি না ওঠা পর্যন্ত চলতেই থাকে। লালা ঝরানোর ফলে বাচ্চার মুখ ও গলার আশেপাশে চামড়া লাল হতে পারে। তাছাড়া ও এই সময়ে চুলকানিও দেখা দিতে পারে।
- কামড়ানোর প্রবণতাঃ দাঁত ওঠার সময় বাচ্চারা যেকোনো কিছুই কামড়াতে চায়, কারণ দাঁত ওঠার ফলে তাদের মাড়ি চুলকাতে থাকে। এটি তাদের জন্য অস্বস্তিকর হয়। তাই বাচ্চারা যেকোনো কিছু কামড়ানোর মাধ্যমে তাদের সেই অস্বস্তি দূর করতে চেষ্টা করে। এটা স্বাভাবিক বিষয়, প্রতিটি বাচ্চা এই কাজটি করে থাকে।
- মাড়ির লালচে ও ফুলে যাওয়াঃ দাঁত ওঠার সময় বাচ্চার মাড়ি লালচে বা ফুলে যেতে পারে। এটি দাঁতের চাপের কারণে হয় এবং এর ফলে মাড়ি একটু স্পর্শকাতর হয়ে যায়। যার কারনে মাড়ি লালচে এবং ফুলে যেতে পারে।
- কান ও গালে হাত দেওয়াঃ বাচ্চারা দাঁত ওঠার সময় কান বাগালে হাত দেওয়ার প্রবণতা দেখায়। এটি দাঁত ওঠার সময় মাড়ি থেকে কানে বা গালে ব্যথা সঞ্চালনের কারণে হতে পারে। পিতা মাতার এই লক্ষণটি দেখে বুঝা উচিত যে বাচ্চার দাঁত উঠছে।
- বিরক্তি ও কান্নাঃ দাঁত ওঠার সময় বাচ্চারা সাধারণত অস্থির ও বিরক্তি অনুভব করে। তাদের কান্নার প্রবণতাও বেড়ে যায়। কারণ দাঁত ওঠার সময় তারা প্রচন্ড অসস্তিবোধ করে।
- ঘুমের ব্যাঘাতঃ দাঁত ওঠার সময় বাচ্চারা রাতে ভালোভাবে ঘুমাতে পারে না। তাদের মাড়ির ব্যথা এবং অস্বস্তির কারণে ঘুমের মধ্যে অনেকবার জেগে ওঠে বা ঘুম ভেঙে যায়। এই সময় পিতা-মাতার ধৈর্য ধরে তাদের সন্তানের পাশে থাকা উচিত।
- খাবার খেতে অস্বস্তিঃ বাচ্চারা দাঁত ওঠার সময় খাবার খেতে চায় না। তারা বেশিরভাগ সময় খাদ্য থেকে বিরত থাকে, কারণ এই সময় তাদের খাদ্য খেতে অস্বস্তি বোধ হয়। মাড়ির ব্যথার কারণে তারা শক্ত খাবার খেতে চায় না । এই সময়টিতে তারা শুধু তরল বা নরম খাবার গ্রহণ করতে চায়।
- হালকা জ্বরঃ কিছু বাচ্চার দাঁত ওঠার সময় হালকা জ্বর হতে পারে। যদিও এটা সাধারণত মারাত্মক নয়, তবে উচ্চ জ্বর হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
- ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানাঃ দাঁত ওঠার সময় অনেক বাচ্চাদের হালকা ডায়রিয়া হতে পারে। তবে এটি যদি দীর্ঘস্থায়ী বা মারাত্মক হয়, তাহলে এক্ষেত্রেও চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
- মুখে হাত দেওয়াঃ বাচ্চারা দাঁত ওঠার সময় মুখে হাত দেয়া বা মাড়ি চেপে ধরে রাখতে চায়। এটি মাড়ির চাপ কমানোর জন্য তাদের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। তা এখানে কোন চিন্তার বিষয় নেই।
দাঁত ওঠার সময় বাচ্চার বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ দেখা যায়। এদের মধ্যে কোনটি স্বাভাবিক কোনোটি আবার অস্বাভাবিক হতে পারে। বাচ্চার ক্ষেত্রে কোন কিছু চিন্তা না করেই, যে কোন সমস্যা তে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
বাচ্চাদের দাঁত ওঠার সময় কিছু করণীয় দিক
বাচ্চাদের দাঁত ওঠার সময় পিতা-মাতার কিছু করণীয় দিক রয়েছে। কারণ সেই সময় পিতা-মাতা ছাড়া তার পাশে কেউ থাকে না। নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা হলো -
বাচ্চার মাড়ির ব্যথা কমানোর উপায়
দাঁত ওঠার সময় মাড়িতে চাপ ও ব্যথা অনুভব হয়। এই বিষয়টি বাচ্চাদের অসস্তি ও কান্নার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মাড়ির ব্যথা বাচ্চার জন্য অনেক যন্ত্রণাদায়ক হয়ে থাকে। তাই মাড়ির ব্যথা কমানোর জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। সেগুলোর নিচে উল্লেখ করা হলো -
- ঠান্ডা খাবার ও দাঁতের রিংঃ ঠান্ডা দাঁতের রিং বা ঠান্ডা খাবার বাচ্চাদের মাড়ির ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। আপনি দাঁতের রিং কে ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করে, বাচ্চার মাড়িতে দিয়ে বাচ্চাকে চুষতে দিতে পারেন। এটি করলে বাচ্চার মাড়ির চাপ ও ব্যথা অনুভব কম হবে। এই পদ্ধতি মাটির ব্যথা ও চাপ কমাতে অনেক কার্যকর উপায়।
- নরম মাড়ির ম্যাসাজঃ মাড়ির ম্যাসাজ বাচ্চাদের ব্যথা ও চাপ কমাতে সহায়তা করে থাকে। পিতা-মাতা বা অভিভাবকরা পরিষ্কার আঙুল দিয়ে বাচ্চার বাড়িতে নরমভাবে ম্যাসাজ করতে পারেন। এছাড়া ম্যাসাজ করার জন্য কিছু বিশেষ মাড়ির ব্রাশ পাওয়া যায়, আপনারা চাইলে বাজার থেকে তা কিনে এনে ব্যবহার করতে পারেন।
বাচ্চাকে ব্যস্ত রাখা
দাঁত ওঠার সময় বাচ্চাদের অস্বস্তি ও বিরক্তি থেকে মুক্তি দিতে, তাদের মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে রাখতে হবে। এর ফলে বাচ্চা অন্যমনস্ক হয়ে থাকবে এবং কম ব্যথা অনুভব করবে । বাচ্চাকে ব্যস্ত রাখতে এবং তাদের মনোযোগ ভিন্ন দিকে সরিয়ে রাখার জন্য কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। সেগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো -
- গান শোনানো বা গল্প বলাঃ গান শোনানো বা গল্প বলা বাচ্চাকে শান্ত রাখতে পারে। তাদের প্রিয় গান বা গল্প শোনালে তারা কিছুক্ষণের জন্য দাঁতের ব্যথা ভুলে যাবে। যদি তাদের কোন প্রিয় গান না থাকে তাহলে বাচ্চা যে জিনিস শুনতে পছন্দ করে কিংবা আপনি বাচ্চাকে যা করলে বাচ্চা হাসিখুশি থাকে, সে আচরণগুলো বা দিকগুলো করবেন।
- নরম খেলনাঃ বাচ্চাকে নরম খেলনা দেওয়া যেতে পারে, যাতে তারা দাঁত ওঠার সময় এটি কামড়াতে পারে। এটি তাদের মাড়ির চাপ কমাতে সাহায্য করবে।
খাদ্য তালিকায় পরিবর্তন আনা
দাঁত ওঠার সময় বাচ্চারা সাধারণত শক্ত খাবার খেতে অস্বস্তি বোধ করে। তাই তাদের জন্য নরম খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। এই সময়টিতে তাদের খাদ্য তালিকায় কিছু পরিবর্তন আনা যেতে পারে। সেগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো -
- নরম ও তরল খাবারঃ বাচ্চার খাদ্য তালিকায় নরম ও তরল খাবার অন্তর্ভুক্ত করা উচিত । এই নরম ও তরল খাবার খেতে বাচ্চার অস্বস্তি হবে না। পিউর করা ফল, সবজি, দই ইত্যাদি খেতে দেওয়া যেতে পারে।
- ঠান্ডা খাবারঃ ঠান্ডা খাবার যেমন ঠান্ডা দই বা ফলের পিউরি বাচ্চার মাড়ির চাপ কমাতে সহায়তা করতে পারে। কারণ এগুলো মাড়িকে ঠান্ডা করতে সহায়তা করবে।
পর্যাপ্ত বিশ্রামের ব্যবস্থা
দাঁত ওঠার সময় বাচ্চারা প্রায়ই ঘুমের ব্যাঘাতের শিকার হয়। তারা রাতে ভালোভাবে ঘুমাতে পারে না। তাছাড়াও তাদের ঘুমের রুটিন ব্যাহত হতে পারে। এই সময় বাচ্চাদের পর্যাপ্ত বিশ্রামের ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরী। নিচে কয়েকটি ব্যবস্থা উল্লেখ করা হলো -
- নিয়মিত ঘুমের সময়ঃ একটি নিয়মিত ঘুমের রুটিন স্থাপন করা উচিত, যাতে বাচ্চারা নির্দিষ্ট সময় ঘুমাতে পারে। এটি তাদের বিশ্রামের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন।
- শান্ত পরিবেশঃ ঘুমের আগে বাচ্চাকে শান্ত পরিবেশে রাখা উচিত। যেমন অল্প আলো, কম শব্দ ইত্যাদি। এতে তাদের ঘুমানো সহজ হবে।
দাঁতের যত্ন নেওয়া
দাঁত ওঠার পর থেকেই বাচ্চার দাঁতের যত্ন নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। বাচ্চারা যাতে দাঁত পরিষ্কার রাখতে অভ্যস্ত হয়, সেই দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। তার জন্য পিতা-মাতার সতর্ক থাকতে হবে। নিচে এ বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ উল্লেখ করা হলো -
- নরম ব্রাশ ব্যবহারঃ বাচ্চার দাঁতের জন্য নরম ব্রাশ ব্যবহার করা উচিত। নরম ব্রাশ তাদের দাঁতের জন্য আরামদায়ক হবে।
- ব্রাশ করার অভ্যাস গড়ে তোলাঃ বাচ্চাকে প্রতিদিন ব্রাশ করার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য, পিতা-মাতার উচিত প্রতিদিন সকালে ও রাত্রে একসাথে বাচ্চাকে নিয়ে দাঁত ব্রাশ করা। এতে বাচ্চা সেই বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে নিবে, এবং প্রতিনিয়ত করবে।
দাঁতের ব্যথা কমানোর জন্য ঔষধ
দাঁত ওঠার সময় ব্যথা খুব বেশি হলে কিছু ঔষধ ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। চিকিৎসক বাচ্চাদের জন্য উপযোগী মাড়ির জেল বা ব্যথা নাশক ওষুধের পরামর্শ দিতে পারবেন।
বাচ্চাদের আদরও স্নেহ
দাঁত ওঠার সময় বাচ্চাদের জন্য পিতা-মাতার আদর ও স্নেহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় তারা কিছুটা অস্থির ও বিরক্তি বোধ করে, তাই তাদের পাশে থেকে তাদের আদর ও স্নেহ দিয়ে শান্ত রাখার চেষ্টা করা উচিত। তারা যে বিষয়টিতে মজা পায়, তাদের সাথে সেই আচরণ করা উচিত। এতে তারা কষ্ট ভুলে, কিছুটা সময় হলেও মজা করতে পারবে।
লেখক মন্তব্য
দাঁত ওঠার সময় বাচ্চাদের সঠিক যত্ন ও সহায়তা প্রদান করা পিতা মাতার দায়িত্ব ও কর্তব্য। দাঁত উঠার লক্ষণ সম্পর্কে জানাও পিতা-মাতার দায়িত্ব। দাঁত ওঠার লক্ষণ সম্পর্কে জানার মাধ্যমে পরবর্তী পদক্ষেপ গুলো আপনি খুব সহজে নিতে পারবেন। সব সময় চেষ্টা করবেন বাচ্চা যেন কোন কিছুতে কষ্ট না পায়। সব সময় বাচ্চাদের সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপন দেওয়ার চেষ্টা করবেন।
আপনার মন্তব্যটি এখানে লিখুন
comment url