লটকন খাওয়ার উপকারিতা এবং অপকারিতা-বিস্তারিত জানুন
লটকন এর বৈজ্ঞানিক নাম হলো Baccaurea ramiflora , লটকন খাওয়ার উপকারিতা এবং অপকারিতা দুটো রয়েছে। তবে লটকন খাওয়ার উপকারিতা বেশি। বাংলাদেশের একটি সুপরিচিত এবং জনপ্রিয় ফল হলো লটকন। এর স্বাদ মিষ্টি ও টক মিশ্রিত। লটকন অনেক পুষ্টিগুনে ভরপুর একটি ফল।
লটকন এর শুধু স্বাদ নয়, এর পুষ্টিগুণ এবং স্বাস্থ্য উপকারিতা ও অনেক। লটকন হল প্রাকৃতিক ফল। আকৃতিকভাবে উৎপন্ন হয়ে থাকে লটকন। কিছু কিছু লটকন কৃত্রিমভাবে পাকানো হয়, সেগুলো থেকে আমরা বিরত থাকবো। এই ব্লক পোস্টে আমরা লটকন খাওয়ার উপকারিতা এবং অপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
লটকন খাওয়ার উপকারিতা
লটকন একটি পুষ্টিকর ফল। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, ভিটামিন এ, ক্যালসিয়াম এবং আয়রন রয়েছে। তাছাড়াও লটকনে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার এন্টিঅক্সিডেন্ট এবং ফাইবার। লটকনের কয়েকটি উপকারিতা সম্পর্কে জানি -
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিঃ লটকনের প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন রয়েছে। ভিটামিন সি এবং এ লটকনে বিদ্যমান। ভিটামিন সি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থেকে বৃদ্ধি করে এবং শক্তিশালী করে। ভিটামিন খাওয়ার ফলে আমাদের শরীরে সর্দি-কাশির অন্যান্য সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
- ত্বকের জন্য উপকারীঃ লটকনে থাকা ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। লটকন ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে। এটি ত্বকের বয়স কমিয়ে ত্বককে তরুণ রাখে।লটকন খাওয়ার ফলে ত্বকের বিভিন্ন বলিরেখা কমে যায়। বলিরেখা কমর ফলে ত্বক সুন্দর হয়। তাছাড়াও ত্বক আরো কোমল ও মসৃণ করতেও লটকনের ভূমিকা রয়েছে।
- হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়ঃ লটকন খাওয়ার উপকারিতা হৃদরোগেও কার্যকর। পটাশিয়াম এবং ফাইবার হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে ভূমিকা রাখে। আমরা সকলেই জানি পটাশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এর ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। তাছাড়াও ফাইবার কোলেস্টর মাত্রা কমতে সাহায্য করে। এর ফলে হৃদরোগের স্বাস্থ্য রক্ষা হয়।
- হজমে সহায়কঃ লটকনের প্রচুর ফাইবার থাকে। ফাইবার আমাদের শরীরে হজমে সহায়ক। এটি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। তাছাড়াও পেট পরিষ্কার রাখতেও লটকনের ভূমিকা রয়েছে। লটকন খেলে গ্যাসটিকের সমস্যা কমে যায়। লটকনে থাকা ফাইবার হজম প্রক্রিয়াকে উন্নত করে।
- রক্তাল্পতা প্রতিরোধ করেঃ লটকনে প্রচুর পরিমাণে আইরন থাকে। আইরন আমাদের শরীরে রক্তস্বল্পতা দূর করে।আয়রন রক্তের হিমোগ্লোবিন মাত্রা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। তাছাড়াও আয়রন শরীরে অক্সিজেন পরিবহন উন্নত করতে ভূমিকা রাখে। তাই লটকন আমাদের শরীরের রক্তাল্পতা এবং দুর্বলতা দূর করতে সাহায্য করে।
- ওজন কমাতে সহায়কঃ লটকনে ক্যালরি কম থাকায়, লটকন আমাদের শরীরে ওজন কমাতেও ভূমিকা পালন করে। লটকন খেলে পেট ভরে যায় এবং ক্ষুধা কমে যায়। যার ফলে আমাদের ওজন কমাতে সমস্যা হয় না। তাছাড়া লটকনে থাকা ফাইবার হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে যা ওজন কমাতেও সাহায্য করে।
- অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধঃ লটকনে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের ফ্রি জারটিকাল থেকে রক্ষা করে। এটি ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট মানুষের বয়সের ছাপ দেরিতে আনতেও ভূমিকা পালন করে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার খেলে শরীরের কোষগুলো সুস্থ থাকে। তাছাড়া ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বার্ধক্য জনিত রোগের ঝুঁকি কমায়। যা আমাদের শরীরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষা করেঃ লটকনে থাকা ক্যালসিয়াম হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে ভূমিকা পালন করে। লটকন হারকে মজবুত করে। তাছাড়াও লটকন হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। নিয়মিত লটকন খেলে অস্টিওপরশিসের ঝুঁকি কমে এবং হাড়ের ক্ষয় রোধ হয়।
- মস্তিষ্কের জন্য উপকারীঃ লটকনে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এবং মিনারেলস। তাই লটকন মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। মস্তিষ্কের স্মৃতিশক্তি উন্নত করাতেও লটকনের ভূমিকা রয়েছে। তাছাড়া আমাদের শরীরের মানসিক চাপ কমে যায় লটকন খাওয়ার ফলে। মনোযোগ বৃদ্ধিতেও লটকন খাওয়ার উপকারিতা রয়েছে।
- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করেঃ লটকন খাওয়ার উপকারিতা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও বিদ্যমান। লটকনে থাকা পটাশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। লটকনের থাকা পটাশিয়াম রক্তের সোডিয়াম ব্যালেন্স রক্ষা করে, এর ফলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনতেও লটকন কাজ করে। লটকন উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য বিশেষভাবে উপকারী।
লটকন একটি পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ ফল। এটি সঠিক ভাবে খাওয়ার ফলে শরীরের অনেক উপকার হতে পারে। লটকন খাওয়ার ফলে শরীরের স্বাস্থ্য সঠিকভাবে টিকিয়ে রাখতে পারব। কিন্তু লটকন অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে শরীরে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। তা নিয়ে এখন আমরা জানব-
লটকন খাওয়ার অপকারিতা
জনপ্রিয় ফল লটকন খাওয়ার ফলে অনেক উপকারিতা যেমন রয়েছে তেমনি অপকারিতাও রয়েছে। লটকন খাওয়ার অপকারিতা গুলো সম্পর্কে এখন আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব-
- পেটের সমস্যাঃ লটকন খাওয়ার অপকারিতা মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ হলো পেটের সমস্যা। অতিরিক্ত লটকন খাওয়ার ফলে শরীরে পেটের ব্যথা, ডায়রিয়া এবং ভূমির সমস্যা দেখা দিতে পারে। লটকনে থাকা ফাইবার অতিরিক্ত গ্রহণ করলে হজমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা বেশি দেখা দিতে পারে।
- এলার্জি সমস্যাঃ কিছু মানুষের লটকনে এলার্জি হতে পারে। এই অ্যালার্জি সাধারণত ত্বকে চুলকানি, ফুসকুড়ি, শ্বাসকষ্ট এবং চোখে পানি আসার মত লক্ষণ প্রকাশ করে। অনেক মানুষের আগে থেকে কোন ফল বা খাদ্যদ্রব্য তে এলার্জি রয়েছে, তাদের লটকন খাওয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন করে চলতে হবে।
- রক্তচাপ কমাতে পারেঃ লটকনে মাত্রা রিক্ত পটাশিয়াম রয়েছে। তাই রক্তচাপ কমাতে লটকন ভূমিকা পালন করে। রক্তচাপ কমানো একটি উপকার হলেও অনেক মানুষের অতিরিক্ত কমে যেতে পারে, যার ফলে হাইপ্রোটেনশনের ঝুঁকি হতে পারে। যাদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে না তাদের জন্য লটকন সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
- রক্তের শর্করা কমাতে পারেঃ লটকন খেলে রক্তের শর্করা কমে যেতে পারে। যারা ডায়াবেটিস রোগী তাদের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাদের লটকন খাওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এর কারণ হলো রক্তের শর্করা অতিরিক্ত কমে গেলে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। তাই ডায়াবেটিকস রোগীদের জন্য লটকন খাওয়ার অপকারিতা মেনে চলতে হবে।
- কিডনি রোগের সমস্যাঃ অনেক মানুষেরই কিডনিতে সমস্যা রয়েছে, তাদের জন্য লটকন খাওয়া অনেক ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। লটকনে থাকা পটাশিয়াম কিডনির উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে। যার ফলে কিডনির কার্য ক্ষমতা কমে যায়। কিডনির কার্যক্ষমতা কমে গেলে কিডনিতে অনেক সমস্যা দেখা দেয়।
- ওষুধের সাথে প্রতিক্রিয়াঃ কিছু ওষুধের সাথে লটকন প্রতিক্রিয়া করতে পারে। যে সকল মানুষের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা কিডনির সমস্যা রয়েছে। তাদের নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হয়, বিভিন্ন ওষুধের সাথে লটকন প্রতিক্রিয়া করতে পারে। তাই এই সকল রোগীদের লটকন খেতে হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে খাওয়া উচিত।
- অতিরিক্ত খেলে বমিঃ অতিরিক্ত কোন কিছু খাওয়াই ভালো না। লটকন অতিরিক্ত খেলে বমি হতে পারে। কারণ লটকন হজমের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে এবং পেটের অসুস্থতি বাড়াতে পারে। তাই আমাদের সকলের পরিমিত পরিমাণে লটকন খাওয়া উচিত।
- গর্ভবতী নারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণঃ লটকন খাওয়ার অপকারিতা গর্ভবতী নারীদের জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ লটকন গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই গর্ভবতী নারীদের লটকন খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। নয়তোবা এটি অনেক ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
মানুষের বিভিন্ন সমস্যার কারণে সকল সমস্যা তুলে ধরা যায় না। তাই অন্য সমস্যাও থাকতে পারে যার জন্য লটকন খাওয়ার অপকারিতা আপনার জন্যও কার্যকর হতে পারে।
লটকন খাওয়ার প্রাকৃতিক পদ্ধতি
লটকন খাওয়ার উপকারিতা পেতে হলে এটি প্রাকৃতিকভাবে খাওয়া উচিত কথাটি সত্য। কেননা বর্তমানে অনেক জায়গায় কৃত্রিম প্রক্রিয়াজাত লটকনে কেমিক্যাল দিয়ে লটকন পাকানো হচ্ছে। যা আমাদের স্বাস্থানের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই আমাদের সকলেরই উচিত লটকন সব সময় তাজা এবং প্রাকৃতিক উপায়ে খাওয়া। এর জন্য আপনারা লটকন গাছের ফল খাবেন। বাজার থেকে লটকন কিনলে দেখেশুনে কিনবেন।
লটকন খাওয়ার কিছু সতর্কতা
যদিও লটকন খাওয়ার উপকারিতা রয়েছে, তবুও লটকন খাওয়ার অপকারিতা সম্পর্কেও সচেতন থাকা জরুরী। লটকন খাওয়ার সময় কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। যেগুলো আমাদের লটকন খাওয়ার অপকারিতা থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে। নিচে কয়েকটি উপায় দেওয়া হলোঃ
- পরিমিত পরিমাণে খাওয়াঃ লটকন খাওয়ার সময় পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত। অতিরিক্ত লটকন খাওয়া যাবে না।
- এলার্জি পরীক্ষাঃ যাদের ফল বা খাদ্যদ্রব্য এলার্জি রয়েছে, তাদেরকে অবশ্যই লটকন খাওয়ার পূর্বে শরীরের এলার্জি পরীক্ষা করানো উচিত।
- ডাক্তারের পরামর্শঃ যাদের রক্তচাপ ডায়াবেটিস বা কিডনির সমস্যা রয়েছে, সেই সকল ব্যক্তির অবশ্যই লটকন খাওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
- গর্ভবতী নারীদের জন্য সতর্কতাঃ গর্ভবতী নারীদের লটকন খাওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ এই সময়ে ছোট ছোট ভুল ও করা যাবে না।
লেখক মন্তব্য
লটকন একটি পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ফল। লটকন আমাদের শরীরে বিভিন্ন উপকারে কাজে আসে। আবার এই লটকনে আমাদের শরীরে বিভিন্ন অপকারিতা নিয়ে আসে। তবে লটকন ফলে শরীরে আমরা উপকারিতা নিয়ে আসতে পারবো লটকন সতর্কতার সাথে খাওয়ার মাধ্যমে। আমরা সকলেই অতিরিক্ত লটকন খাওয়া থেকে বিরত থাকবো। এবং অবশ্যই লটকন খাওয়ার উপকারিতা এবং লটকন খাওয়ার অপকারিতা সম্পর্কে আগে জানব তারপরে লটকন খাব। সঠিক পরিমাণে এবং সঠিক সময় লটকন খেলে আপনি লটকনের পুষ্টিগুণ এবং স্বাস্থ্য উপকারিতা উপভোগ করতে পারবেন।
আপনার মন্তব্যটি এখানে লিখুন
comment url